Summary
একটি গ্রামের জুমচাষি দম্পতির একটি মেয়ে ছিল। তারা সুখে জীবন কাটাচ্ছিল। একদিন তারা মেয়েকে ধান শুকাতে রেখে বেরিয়ে গেল। কিন্তু টিয়া পাখিরা ধান খেয়ে ফেলে এবং মেয়েটি বাবা-মার মারধরের শিকার হয়। মেয়েটি আবেগে টিয়ার সন্ধানে যেতে শুরু করে। পথে সে বিভিন্ন রক্ষকের সঙ্গে দেখা করে, যারা তাকে সঠিক পথ দেখায়।
শেষে মেয়েটি টিয়াদের দেশে পৌঁছায় এবং সেখানে সাদা ও হলুদ টিয়া তাকে আতিথ্য দেয়। বান্ধবী হিসেবে চলা মেয়েটি তার দুঃখের কথা বলে, পরে টিয়ারা তাকে সোনার ও রূপার মোহরসহ বাড়িতে ফেরত পাঠায়।
মেয়ে বাড়ি ফিরে এসে সোনা-রূপার মোহর পেয়ে মা-বাবা খুশি হয়। তবে লোভী বাবা-মা তাদের অন্য একটি মেয়েকে টিয়াদের দেশে পাঠায়। ঐ মেয়েটি লোভে পড়ে। টিয়ারা তাকে কলস উপহার দেয়, কিন্তু কলসের মুখ খুললে মারাত্মক সাপ বের হয়ে সবাইকে দংশন করে নির্বংশ করে দেয়।

অনেক দিন আগের কথা। এক গ্রামে এক জুমচাষি দম্পতি ছিল। তাদের একটি মেয়ে ছিল। খুবই সুখে দিন কাটছিল তাদের। প্রতিদিন অতি প্রত্যুষে ঘুম থেকে উঠে ওই দম্পতি রান্না বান্না সেরে, খেয়ে, জুমচাষের কাজে বেরিয়ে পড়ত। মেয়েটিকে ঘরে রেখে যেত। সে ঘর পাহারা দিত আর ঘরের খুঁটিনাটি কাজ করত। সন্ধ্যায় মা-বাবা ফিরে আসত। আবার রাতের রান্না সেরে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। এভাবে তাদের দিন অতিবাহিত হতে লাগল। একদিন তারা মেয়েকে ধান শুকাতে বলে গেল। মা-বাবা বেরিয়ে যাবার পর তাদের নির্দেশমতো উঠানে ধান শুকাতে দিল। পাশে বসে সে পাহারা দিতে লাগল যাতে কোনো পশুপাখি খেতে না-পারে। ধান প্রায় শুকিয়ে এসেছে। তুলতে যাবে এমন সময় হঠাৎ কোথেকে এক ঝাঁক সাদা টিয়া আর হলুদ টিয়া এসে ধানের ওপর বসল। একটা-দুটো করে এক নিমেষে সব ধান খেয়ে শেষ করে ফেলল। মেয়েটি তাদেরকে অনেক নিষেধ করল। বলল, 'লক্ষ্মী টিয়ারা, তোমরা ধান খেয়ো না। বাবা-মা ফিরে এসে ধান না দেখলে আমাকে মেরে ফেলবে।' টিয়ারা বলল, 'আমরা একটু খাব, মা-বাবা বকলে, মারলে, আমাদের কাছে চলে এসো।' সন্ধ্যায় মা-বাবা ফিরে এসে ধান না দেখে মেয়েকে ভীষণ বকুনি দিল। তারা মনে করল, সে নিশ্চয় পাহারা দেয়নি।
পরদিন তারা আবার ধান শুকাতে দিয়ে গেল। সেদিনও একই ঘটনা ঘটল। সেদিন মা-বাবা মেয়েকে অলস ভেবে ভীষণ মারধর করল। মেয়েকে সাবধান করে বলল, 'আবার যদি টিয়াদের ধান খাওয়াস তাহলে তোকে মেরে তাড়িয়ে দেব।' তার পরদিনও ধান শুকাতে দিয়ে গেল। মেয়েটি শত চেষ্টা করেও টিয়াদের বারণ করে ধান রাখতে পারল না। সে বসে কাঁদতে লাগল। মা-বাবা ফিরে এসে বুঝতে পারল একই ঘটনা। এতে আর কোনো ভুল নেই। যেই কথা সেই কাজ। মেয়েকে তাড়িয়ে দিল। মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে টিয়াদের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল। অচেনা পথে যেতে যেতে যখন ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পড়ল, তখন একজন রাখালের দেখা পেল। মেয়েটি রাখালকে জিজ্ঞেস করল, 'রাখাল ভাই, তুমি কি সাদা টিয়া, হলুদ টিয়ার দেশের সন্ধান দিতে পারো?' রাখাল উত্তর দিল-
লক্ষ্মী মেয়ে বলছি তোমায় শোনো,
সাদা টিয়ে হলুদ টিয়ের সন্ধান তোমায় দেবো।
এক মুঠো ভাত, এক আঁজলা পানি খেয়ে একটু জিরিয়ে নাও
তারপরেতে সোজা ওই দক্ষিণ-পূর্ব দিকে যাও।
মেয়েটি তা-ই করল। একটু বিশ্রাম করে আবার পথ চলা শুরু করে দিল। যেতে যেতে এবার পৌঁছাল মেষপালকের কাছে। মেয়েটি মেষপালককে জিজ্ঞেস করল, 'মেষপালক ভাই, তুমি কি সাদা টিয়া হলুদ টিয়ার দেশ কোনদিকে বলতে পারো?' মেষপালক মেয়েটিকে আদর-যত্ন করে বসতে দিল। বলল-
লক্ষ্মী মেয়ে শোনো তোমায় বলি
এক মুঠো ভাত, এক আঁজলা পানি খাও, এই অনুরোধ করি।
সাদা টিয়ে হলুদ টিয়ের দেশে যেতে চাও
তো দক্ষিণপূর্ব দিকের পথটি ধরে যাও।
মেয়েটি মেষপালকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এগিয়ে চলল। সারাদিন যেতে যেতে সন্ধ্যায় পরিশ্রান্ত হয়ে এক অশ্বরক্ষকের কাছে পৌঁছাল। সে অশ্বরক্ষককে সাদা টিয়া, হলুদ টিয়ার দেশে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দিতে বলল। অশ্বরক্ষক বলল-
লক্ষ্মী মেয়ে, এক মুঠো ভাত, এক আঁজলা পানি খাও
শ্রান্ত তুমি, একটু জিরিয়ে নাও।
দক্ষিণপূর্ব দিকে তোমায় যেতে হবে
সাদা টিয়ে, হলুদ টিয়ের দেখা তবে পাবে।
এই বলে কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর অশ্বরক্ষক মেয়েটিকে বিদায় দিল। মেয়েটি সারা দিন যেতে যেতে এবার সন্ধ্যায় হস্তীরক্ষকের কাছে গিয়ে পৌঁছাল। পথ যেন ফুরাতে চায় না। মেয়েটির মনে হলো সে, ক্লান্ত। তারপর হস্তীরক্ষকের কাছে জিজ্ঞাসা করল, 'সাদা টিয়া, হলুদ টিয়ার দেশে পৌঁছাতে আর কতদিন লাগবে?'
হস্তীরক্ষক তাকে সাহস দিয়ে বলল-
লক্ষ্মী মেয়ে এসেছ তুমি সঠিক পথটি ধরে
তবে এক মুঠো ভাত, এক আঁজলা পানি খেয়ে একটু জিরোতে হবে
আর মাত্র এক ক্রোশ পথ যেতে হবে
সাদা টিয়ে হলুদ টিয়ের তবেই দেখা পাবে।
হস্তীরক্ষকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার পথ চলতে লাগল মেয়েটি। সে বুঝতে পারল, সবাই তাকে সত্যি কথা বলছে, সঠিক পথ দেখিয়ে দিয়েছে। সবাই তাকে ফেরার পথে তাদের আতিথ্য গ্রহণ করতে অনুরোধ করেছে। এক ক্রোশ পথ অতিক্রম করার পর মেয়েটি ক্লান্ত অবসন্ন দেহে অবশেষে টিয়াদের দেশে পৌঁছাল।
চারিদিকে তাকাতেই সামনে সে দেখতে পেল এক সুবর্ণ অট্টালিকা। একটু জিজ্ঞেস করতেই মেয়েটির পরিচয় ও উদ্দেশ্য জানতে পেরে সাদা টিয়া, হলুদ টিয়ারা তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানাল। সোনার সিঁড়ি, রূপার সিঁড়ি কোনটা বেয়ে ঘরে ওঠার ইচ্ছা তারা জানতে চাইল। মেয়েটি বলল তারা, গরিব তাই কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে অভ্যন্ত। মেয়েটিকে তাই করতে দিল। বাড়িতে ঢুকে চারিদিকে ঐশ্বর্যের ছড়াছড়ি দেখে সে অবাক হয়ে গেল। পরিশ্রান্ত মেয়েটিকে স্নান করিয়ে সুন্দর সুন্দর পোশাক পরতে দিল।
তারপর সোনার থালায় রূপার থালায় করে রকমারি খাবার খেতে দিল। মেয়েটি ওইসব থালায় খেতে অভ্যন্ত নয় তাই সে সাধারণ থালায় খেল। জীবনে কোনোদিন খায়নি এমন খাবার! তাই সে খুব তৃপ্তি সহকারে খেল। শোবার ঘরে নিয়ে গেল রাতে। সেখানেও সোনার খাটে রূপার খাটে শুভ্র কোমল বিছানা করা হয়েছে দেখতে পেল। কোনোটাতে ঘুমাবে জানতে চাইলে মেয়েটি বলল, তারা গরিব। জীবনে কোনোদিন ওইসব খাটে শোয়নি। মেঝেতে শুতেই অভ্যন্ত। তারা তাকে মেঝেতেই শুতে দিল। পরদিন সে টিয়াদের তার দুঃখের কথা জানাল। মা-বাবা অলস, অকর্মণ্য ভেবে তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। টিয়ারা তাকে সান্ত্বনা দিল। সুন্দর পোশাক-পরিচ্ছদ, সাত কলস সোনা ও রুপার মোহর আর কয়েকজন রক্ষী দিয়ে মেয়েটিকে মা-বাবার কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিল। ফেরার পথে তার শুভাকাঙ্ক্ষী রাখাল, মেষপালক, অশ্বরক্ষক, হস্তীরক্ষক সবার সঙ্গে দেখা করে তাদের সহযোগিতার জন্য অশেষ ধন্যবাদ জানাল। তারাও মেয়েটির ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে প্রাণভরে আশীর্বাদ করল।
অবশেষে মেয়েটি নিজের বাড়িতে এসে পৌঁছাল। মা-বাবা তাদের মেয়ে এবং সঙ্গে সোনা-রুপার মোহর পেয়ে তো মহাখুশি। পাড়াপ্রতিবেশীরাও মেয়েটির কাণ্ড দেখে তাজ্জব হয়ে গেল। সবাই কানাঘুষা করতে লাগল, এটা কীভাবে সম্ভব হলো। অনেকেই হিংসায় জ্বলে গেল। অনেকের লোভ সৃষ্টি হলো। এভাবে এক লোভী মা-বাবা তাদের মেয়েকে তাড়িয়ে দিল, সোনা-রুপার মোহর খোঁজ করে আনার জন্য। ওই মেয়েটি সবাইকে জিজ্ঞেস করে করে ঠিকই সাদা টিয়া হলুদ টিয়াদের দেশে পৌঁছাল।
লোভী বাপ-মায়ের সন্তানও লোভী ছিল। এই মেয়েটিকেও পূর্বের মেয়েটির অনুরূপ আদর-যত্ন করা হলো। লোভ সামলাতে না পেরে সে সোনার সিঁড়ি দিয়ে উঠল। সোনার থালায় খেল। সোনার খাটে ঘুমাল। পরদিন তার এখানে আগমনের কারণটা জানাল। টিয়ারা সব শুনে সাতটি কলস ভালো করে মুখ এঁটে মেয়েটিকে দিল। বলে দিল বাড়ি পৌঁছে চট করে যেন কলসের মুখ না খোলে। একটার ভিতর আরেকটা, এভাবে পরপর সাতটি তাঁবু খাটিয়ে সবচেয়ে ভিতরেরটাতে বংশের সব আত্মীয়স্বজনকে ডেকে জড়ো করে তারপর যেন কলসের মুখ খোলে। আত্মীয়স্বজন জড়ো হয়ে যখন কলসের মুখ, খুলল তখন সাতটি কলস থেকে বিভিন্ন জাতের বিষধর সর্প বের হয়ে সবাইকে দংশন করে নির্বংশ করল।
# বহুনির্বাচনী প্রশ্ন
এক দরিদ্র কাঠুরে নদীর ধারে কাঠ কাটছিল। তার কুড়ালটি হঠাৎ পানিতে পড়ে যায়। দেবতা নদীতে ডুব দিয়ে একটি সোনার কুড়াল তুলে নিয়ে আসে। কাঠুরে বলে এটা তার কুড়াল নয়। দেবতা খুশি হয়ে তাকে সোনার কুড়ালসহ তার নিজের কুড়ালটি দেয়।
বাংলাদেশের মারমা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বহু পুরাতন ও মুখে মুখে প্রচলিত 'হলুদ টিয়া সাদা টিয়ার গল্প' বাংলায় ভাষারূপ দিয়েছেন মাউচিং। মাউচিং-এর জন্ম ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে রাঙামাটি জেলার চন্দ্রঘোনায়। পেশাজীবনে তিনি ছিলেন শিক্ষক।
চাষি দম্পতির ছিল এক সহজ-সরল মেয়ে। মেয়েটির বাবা-মা জুমচাষের জন্য সেই ভোরে বেরিয়ে যেত আর কাজ শেষে ফিরত সন্ধ্যায়। তারা তাকে ঘর পাহারা দেওয়া ও অন্যান্য কাজের দায়িত্ব দিয়ে রেখে যেত। একবার ধান শুকাতে গিয়ে মেয়েটি দেখল, একদল হলুদ ও সাদা টিয়া পাখি সব ধান খেয়ে ফেলছে। অনেক অনুরোধ করেও সে তাদের থামাতে পারল না। পরপর কয়েক দিন একই ঘটনা ঘটায় বাবা-মা রেগে গিয়ে মেয়েটিকে তাড়িয়ে দিল। সে তখন খোঁজ খবর নিয়ে টিয়াদের রাজ্যে পৌঁছালে সম্পদশালী টিয়া পাখিরা তাকে অনেক আদর-যত্ন করল। কিন্তু মেয়েটি লোভ না করে সাদাসিধে জিনিস বেছে নিল। টিয়া পাখিরা খুশি হয়ে তাকে সাত কলস সোনার ও রূপার মোহর দিয়ে তার বাবা-মায়ের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করল। বাবা-মাও ভীষণ খুশি হলো। এই খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়ায় কেউ খুব অবাক হলো, কেউ-বা হিংসা করতে শুরু করল। কারো আবার ভীষণ লোভ হলো। এরকমই এক লোভী পরিবার তাদের মেয়েকে তাড়িয়ে দিল সোনা-রূপা পাওয়ার লোভে। সে টিয়া পাখিদের রাজ্যে পৌঁছে লোভ সামলাতে পারল না। তার আচরণ দেখে টিয়া পাখিরা সব বুঝতে পারল। তখন সাতটি কলসের মুখ বেঁধে তারা মেয়েটিকে বলল, বংশের সব আত্মীয় স্বজনকে নিয়ে যেন কলসের মুখ খোলা হয়। বাড়ি ফিরে সবাইকে জড়ো করে মেয়েটি যখন কলসের মুখ খুলল, তখন কলস থেকে বিভিন্ন জাতের সাপ বের হয়ে সবাইকে কামড়ে মেরে ফেলল। এভাবে মেয়েটির পুরো পরিবার নির্বংশ হয়ে লোভের শাস্তি ভোগ করল।
গল্পটিতে সৎ ও নির্লোভ মানুষের জীবনে শেষপর্যন্ত শান্তি-স্বস্তি ফিরে পাওয়া এবং লোভী মানুষের নির্মম পরিণতি দেখানো হয়েছে।
জুমচাষ - পাহাড়ি অঞ্চলে একধরনের চাষাবাদ।
প্রত্যুষে - ভোরে। খুব সকালে।
অতিবাহিত - পার হওয়া।
কোথেকে - কোথা থেকে।
বকুনি - ধমক। তিরস্কার।
বারণ - নিষেধ।
আঁজলা - করপুট।
অশ্বরক্ষক - ঘোড়া লালন-পালন করে যে।
জিরিয়ে - বিশ্রাম নিয়ে।
হস্তীরক্ষক - হাতি দেখাশোনা করে যে।
ক্রোশ - দূরত্বের পরিমাণবাচক শব্দ। দুই মাইলের কিছু বেশি।
আতিথ্য – অতিথিসেবা।
অবসন্ন - ক্লান্ত, শ্রান্ত।
অকর্মণ্য - কর্মক্ষম নয় এমন। অপটু।
অতিক্রম - পার হওয়া।
সুবর্ণ - সোনার মতো রঙ।
অভ্যর্থনা - সাদরে গ্রহণ।
অভ্যন্ত - অভ্যাসের অধীন।
শুভাকাঙ্ক্ষী – কল্যাণকামী।
কানাঘুষা - গোপনে কথা বলা।
দংশন - দাঁত-বসানো, কামড়।
অনুরূপ - সমান।
বংশ - কুল, গোষ্ঠী।
নির্বংশ - বংশধর নেই এমন। কুলহীন।